ভন্ডামির ফল
-বীথিকা সেন
(১)
অজ গ্রাম ‘ভাঁটিডাঙা’।শিক্ষা থেকে শুরু করে কোনো কিছুরই ঠিকঠাক পরিষেবা পাওয়া যায় না এখানে। চিকিৎসার জন্য যেতে হয় নিকটবর্তী শহর ‘নিয়াগঞ্জ’ -এ, যেটা গ্রাম থেকে প্রায় পাঁচ ক্রোশ দূরে। আবার যাতায়াতের তেমনটা সুবিধে নেই এ গ্রামে।
নগেন খুড়ো এ গ্রামের বাসিন্দা। ছেলেপুলে না থাকায় একলা খুড়িমাকে নিয়েই তার সংসার। খুড়িমার শরীর অসুস্থ।নিয়ম বরাদ্দ পথ্যটুকু কাল রাতেই শেষ হয়ে গেছে। অত্যাবশ্যক ওষুধের প্রয়োজন, না হলে কি জানি কখন কি হয়ে যায়? সন্তানাদি না থাকার দরুন করণীয় যা কিছু সবই খুড়োকেই করতে হয়। তাই সাত-পাঁচ না ভেবে পেয়ে নগেন খুড়ো তার নিজের বাইসাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল নিয়াগঞ্জের দিকে, ওষুধ আনতে।
নিয়াগঞ্জ পাঁচ ক্রোশ রাস্তা হলেও একটা বিরাট ফাঁকা মাঠের এক প্রান্তে এই ভাঁটিডাঙা গ্রাম ও অন্য প্রান্তে ঐ শহর। মাঝখানে ক্রোশ দুয়েকের ব্যবধান। সুতরাং মাঠ পেরোলেই কম সহজে শহরের ঠিকানা পাওয়া যায়, যদিও পথ চলতে একটু অসুবিধে। সময়ের তাগিদে এই মেঠো পথই ধরলো নগেন খুড়ো।
(২)
শহরের দিকে অগ্রসিত এই মেঠো পথের পাশেই একখণ্ড পতিত জমি এবং সেখানে একটা প্রকাণ্ড অশ্বত্থ গাছ। যার ঝুরিগুলো এলোমেলো ভাবে বৃদ্ধা বুড়ির জটের মত ঝুলছে। পাশেই অনেক পুরোনো ভগ্নপ্রায় ঘাট বাঁধানো একটি পুকুর। জায়গাটির একটি বিশেষ নামকরণও আছে – ‘পাঠান তলা’।
এ পর্যন্ত পৌঁছানো মাত্রই নগেন খুড়ো থমকে দাঁড়ালো , চমকে উঠে এক দৃশ্য দেখে। দেখেন শুষ্ক রক্ত ধারা ভগ্নপ্রায় ঘাটের উপর দিয়ে বয়ে নেমে পুকুরের জলের সঙ্গে মিশে বিলীন হয়ে গেছে । পাশেই একটি প্রায় দশ-এগারো বছর বয়সী বালিকার দেহ ভূমিষ্ঠ আছে। সে কোনো প্রকারে সাইকেলটা রেখে মেয়েটির কাছে গেল এবং কিছুক্ষণ নিরীক্ষন করে দেখার পর বুঝলো জীবিত কিন্তু সজ্ঞাহীন। দৌড়ে পুকুর থেকে জল এনে তার চোখে মুখে ছিটিয়ে দিতে লাগলো। কিছুক্ষণে মেয়েটি সচেতন হল এবং চোখ মেলে খুড়োকে দেখে কেঁদে বলল নগেন দাদু….
খুড়ো বিস্মিত হয়ে বলল- তুমি আমায় চেনো ?
-হ্যাঁ চিনি! তো তুমি আমাদের পাড়ার নগেন দাদু যে। তুমি আমায় চিনলে না, আমি কচি গো কচি, অমলের মেয়ে।
অমলের মেয়ে বলতেই খুড়োর স্মরণে এলো, অমল তাদের পাড়ার গরীব চাষী। দিন মজুরি করে কোনো প্রকারে দিন কাটায় মেয়ে – বৌকে নিয়ে। খুড়ো বলল- তা তুমি এখানে কিরে এলে ?
আমি তো মাঠে বাবার খাবার দিতে যাচ্ছিলাম, এখানে এসে এই রক্ত দেখে……
এটুকু বলেই সে কাঁদতে আরম্ভ করল । আবার বলল – দাদু আমার ভীষণ ভয় করছে। এখানে এত রক্ত কেন দাদু? তুমি এই রক্তগুলো মুছে ফেলো না, আমার ভীষণ ভয় করছে।
ভয় নেই মা, আমি তো আছি, বলেই খুড়ো চেঁচাতে অারম্ভ করল–কে কোথায় আছো ? এদিকে এসো, এদিকে এসো !
আস্তে আস্তে লোকজনের ভিড় জমে গেল, অমলও এলো।
(৩)
সভ্যতার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত মানুষের বোধ বুদ্ধির বিকাশ ঘটেছে ঠিকই কিন্তু এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে নিষ্ঠুরতা আজো রয়েছে। মনুষ্যত্বে বর্বরতা, আবেগে উন্মদতা এবং হৃদয়ে পাষন্ডতা তাদের মধ্যে বর্তমান। কোনো এক রক্ত পিপাসু দানব তাদের মস্তিষ্কে সর্বদা বিরাজমান। সদাই ধর্মের নামে অর্ধম করে চলেছে তারা।
সমাজের কিছু কুসংস্কার আচ্ছন্ন ভীতু মানুষদের এরা নিজেদের আঙুল দ্বারা চালনা করে। তাদের দূর্বলতা বুঝে ভয় দেখিয়ে বলে প্রতি বছর দ্বিতীয় কৃষ্ণ পক্ষে যদি নর বলি না দেওয়া হয় তবে অমঙ্গল হবে। সমাজের ভীতু কাপুরুষেরা এ কথার কোনো প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা বরং তাদের এই দূরূহ পাপ কাজে আরও সাহায্য করে।
কাল ছিল বছরের সেই দ্বিতীয় কৃষ্ণপক্ষ। অমাবস্যার চাঁদের আলো যখন সর্বগ্রাসী ক্ষুধার্তের মত হাহাকার করছে ঠিক তখনই এই দানব মূর্ত পাষন্ডগুলো নরবলি দিয়ে ফেলল। এদেরই রক্তের ধারা বয়ে গেছে। যে রক্ত ধারায় রয়েছে ‘বাঁচাও বাঁচাও’ আর্তনাদের চিহ্ন।
পাষন্ডদের এই অমানবিক কুসংস্কার আচ্ছন্ন ভন্ডামির কার্যকলাপের ফলেই ছোট্ট বালিকা ‘কচি’ আজ ভীত। এদিকে বুড়ি খুড়িমার না জানি কোন পরিস্থিতি উপস্থিত হয়েছে। সে কি এখনো অপেক্ষা করে আছে তার বেদনা উপশমের পথ্যের জন্য, নাকি তার জীবনের অন্তিম সময়টুকু উপস্থিতির অতীত হয়ে গেছে……..
রইলেম আমি ভন্ডামির বর্ননায় নগেন খুড়োর ঐ বট তলায়, এদিকে অভাগী খুড়িমা চলার পথ প্রায় থামার অপেক্ষায় নাকি চলে গেছে শেষ শয্যায়?